– জ্বী , আমি জিসান ।
– আপনাকে আমাদের এমডি ডাকছেন ।
– আমাকে ? এমডি ?? কেন ?
– সেটা তো জানি না ।
– আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে হয়ত ।
– না ঠিকই আছে । আপনি আসুন আমার সাথে ।
মনে হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে জিসান হাটা শুরু করল । সে জানতনা তার জন্য ওখানে তিনটা চমক অপেক্ষা করছে । যা আবার তাকে রোহমন্থন করে দিবে সাত বছর আগের সেই দিনগুলি ।
-৩
Real Love Story – সত্যিকারের ভালোবাসা।
বাংলা মিষ্টি প্রেমের গল্প | Romantic Love Story
জিসান ৫ তলায় চলে আসল । জায়গাটা ভীষণ সুন্দর , দেখলেই মন ভালো হয়ে যাবে । বোঝাই যায় এমডি অনেক সৌখিন মানুষ । লোকটি জিসানকে এমডির রুম দেখিয়ে দিল । দরজা ঠেলা দিতেই হালকা এয়ারফ্রেশনারের গন্ধ নাকে লাগল । এমডির দিকে চাইতেই প্রথম চমক পেয়ে গেল জিসান । এমডি একজন মহিলা । তিনি মাথা নিচু করে খুব মনযোগ দিয়ে কিছু পড়ছেন । জিসান বলল , আসব ম্যাডাম ?
মুখ না তুলেই তিনি বললেন plz come ।
কন্ঠস্বরটা শুনেই জিসানের বুকের ভিতরটা ধ্বক করে উঠল । অদ্ভুত মিল এই কন্ঠস্বরের । হুবহু এক । দ্বিতীয় চমক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই জিসান তৃতীয় চমক পেয়ে গেল । সেই এমডি ম্যাডাম মুখ তুলে চেয়েছেন । মুখের অবয়বটা দেখে জিসানের পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেল । পুরা দুনিয়া ঘুরতে লাগল চোখের সামনে । মাটিতে পতনের হাত থেকে বাঁচতে কোনমতে দেয়াল ধরে তাল সামলাল । সেই মুখ , সেই মায়াকারা চোখ , সেই ঠোঁট , সেই এলোমেলো চুল , সেই চাহনী । সব আগের মতই আছে । সাত বছরেও যার পরিবর্তন হয়নি শুধু চোখে একটা গোলাপী ফ্রেমের ছশমা যোগ হয়েছে । জিসানের মুখ দিয়ে আনমনেই একটি শব্দই বেড় হয়ে আসল । ইরাবতী । এ যে তার ইরাবতী !
-৪
Real Love Story – সত্যিকারের ভালোবাসা।
ট্রেইনের ঝম ঝম শব্দ হচ্ছে । রাতের আকাশের পূর্ণিমা ট্রেইনের বগির দরজায় দাড়িয়ে উপভোগ করছে দুইজন তরুণ তরুণী । ছেলেটি অনর্গল কথা বলে চলছে আর মেয়েটি লাজুক লাজুক মুখে তা শুনছে , আর মাঝে মাঝে কিসব প্রতিবাদ করে উঠছে । উঠতি এই যুবক যুবতীকে দেখলে মনেই হবেনা তারা বাড়ী থেকে পালিয়ে এসেছে । ট্রেইনটি একটা লোহার ব্রীজ ক্রস করল । ঝম ঝম শব্দটি গুম গুম শব্দে রূপ নিল । হঠাৎ শব্দের এই পরিবর্তনে মেয়েটি ভয় পেয়ে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরল । ছেলেটি হাসিমাখা মুখে বলল ,
– মাই ডিয়ার ইরাবতী কি ভয় পেয়েছে ?
– খবরদার আমাকে ইরাবতী বলবা না । আমার নাম ইরা ।
– ওই হইল , ওইটা আদরের ডাক ।
– আহারে আমার আদর ! ঢং !
– আহা শোননা । যদি এরকম লোহার কালভার্ট গুলো প্রতি ১০০ মিটার পর পর থাকত তবে কি হত জানো ?
– কি হত ?
– তুমি ভয় পেয়ে বারবার আমায় জড়িয়ে ধরতে ।
সাথে সাথে ইরা জিসানকে ছেড়ে দিয়ে বলল ,
– বেয়াদপ কোথাকার !
– প্রাউড টু বি !
– তোমার লজ্জা হবে না কোনদিন ।
– লজ্জা থাকলে তো আর প্রেম করা যায়না গো ডিয়ার ইরাবতী ।
– আবার !
বলেই ইরা আহ্লাদী গলায় জিসানকে জড়িয়ে ধরল । জিসানও গভীর ভালবাসায় ইরার মাথায় মাথা রাখল ।
রাত বাড়ছে । ঝম ঝম ট্রেইনের শব্দটা প্রকট হয়েছে । রাতের প্রকৃতিতে জিসান আর ইরার ভালবাসা ছড়িয়ে দিচ্ছে এক অদ্ভুৎ সৌন্দর্য ! অদ্ভুত এক ভালোবাসার গন্ধে সুরভিত রাতের বাতাস ।
কি হল ? ওখানেই দাড়ায় থাকবা ?
ইরার কথা শুনে জিসান ফিরে এল ছয় বছর আগের স্বপ্নময় দিনগুলো থেকে । টলমল পায়ে এগিয়ে গেল টেবিলের দিলে । ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে । এইত , তার ইরাবতী তার সামনেই । একদম মুখোমুখী । তারই ইরাবতী !
-৫
রুমের ভিতর পিনপতন নিরবতা । এসির মৃদু শব্দটাও কানে বাজছে । ইরা চুপচাপ বসে আছে । জিসানের হতভম্ভ ভাব কাটেনি । এই গম্ভীর পরিবেশ দূর করার জন্য ইরা বলে উঠল ,
– ইন্টারভিউ কেমন হল তোমার ?
– বরাবর যেমন হয় ।
– মানে ?
– ভালোই ।
– ও আচ্ছা ।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ইরা আবার বলল ,
– চা খাবে নাকি কফি ?
– কফি খাই না । অত টাকা কই পাব ? চাই ভাল ।
ইরা কিছু না বলে চা আনতে বলল । জিসান ভাবছে এই ইরা আর আগের ইরার মাঝে কোন মিল নেই । থাকবেই বা কিভাবে । সে তো ছিল ইরাবতী , তার ইরাবতী । আর ইনি , গুরুগম্ভীর , কর্পোরেট ইরা । জিসানের ইরাবতী তো ছিল দুরন্ত । ইরাবতী নদীর স্রোতের মতই যাকে দমিয়ে রাখা ছিল অসম্ভব । চঞ্চল চোখ , বাধ ভাঙ্গা উল্লাস মনে কোন কষ্টকেই আসতে দিতনা । যার চঞ্চলতায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হত বারবার । বারবার বলতে ইচ্ছা হত ভালবাসি , ভালবাসি এবং ভালবাসি ।
ভাবনাগুলো গভীর থেকে গভীরে চলে যাচ্ছিল । কিন্তু জিসান নিজেকে সামলে নিল পুরোন স্মৃতি রোহমন্থন করা থেকে । জিসান নিরবতা ভাঙ্গার চেষ্টা করল । একটু সংকুচিত হয়ে ইরার সাথে কথা বলা শুরু করল ।
-৬
– আমাকে চিনলে কিভাবে ? মানে বুঝলেন কিভাবে বুঝলেন ?
একটু সময় নিয়ে ইরা বলল ,
– বললে কি বিশ্বাস করবে ?
– বিশ্বাস জিনিসটাকেই আমি বিশ্বাস করিনা । সমস্যা নাই । আপনি বলুন ।
– তোমায় অনেক খুঁজেছি । পাগলের মত খুঁজেছি । পরশু ক্যান্ডিডেটদের লিস্টগুলো দেখছিলাম । সেখানেই তোমাকে পাই । আজ সকাল ৯ টা থেকে তোমাকে দেখার জন্য জানালার পাশে বসে আছি ।
– বাহ বাহ । আমার তো রাজকপাল । কোম্পানীর একজন এমডি আমার জন্য সব কাজ ফেলে দুই ঘন্টা জানালার পাশে বসে ছিলেন ।
বলেই জিসান অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল । দ্রুতই নিজেকে সামলে নিল । ইরাকে হাসির জন্য স্যরি বলতে যাবে তখন দেখতে পেল ইরার মুখে গভীর বিষাদের ছায়া । জিসান বুঝতে পারলনা এটা আসলেই বিষাদ নাকি নারীদের চিরায়িত রূপ , ছলনা ।
চা এসে গেছে । জিসান চা খাচ্ছে না । এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চায়ের দিকে । ইরা বলল ,
– কি হল ? চা নাও ।
– চা টার ভিতরে সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে । বড়লোকের চা তো সুন্দর হবেই । এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে ইচ্ছা করছে । চা খেলেই তো সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে । বেঁচে থাকুক সৌন্দর্য ।
চায়ের খয়েরী রংয়ের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে জিসান । খয়েরী রং যে তার খুব প্রিয় । এই রংয়েই আছে কত স্মৃতি ।
-৭
সেদিন শুক্রবার । ইরার সাথে স্পেশাল দেখা করার ডেট । দেখার আবার স্পেশাল কি জিসান বুঝতে পারছে না । মেয়েটা মাঝে মাঝে এত রহস্য করে বলাই বাহুল্য । তারাতারি ফ্রেশ হয়ে কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মাকে কোচিংয়ের কথা বলে বের হল জিসান ।
পার্কের এই কোণাটা ওদের অলিখিত সম্পত্তি । কেউ এসে এদিকে বসে না । গত তিন বছর ধরেই তারা এভাবে এখানে দেখা করে আসছে । ইরা বসে আছে । হাতে দুটো প্যাকেট । কাছে যেতেই ইরা বলল ,
– মহারাজের আসার সময় হল তাহলে ।
– মাই ডিয়ার ইরাবতী , আমি রাইট টাইমেই আসছি । তুমি ই একটু ফাস্ট হয়ে গেছ ।
– উফ ! এই নামটা বলবা নাতো । চল , কাজ আছে ।
– কোথায় ?
– গেলেই বুঝতে পারবে ।
– যথ আজ্ঞা মাই ডিয়ার .…
– চুপ !
দুজনে একটি শপিং মলে আসল । জিসানের হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ইরা বলল ,
– যাও , এইটা পড়ে আস ।
– কি এইটা ?
– যা আছে আছে । যাও তাড়াতাড়ি । আমিও change করে আসছি ।
– বাপরে ! ফুল প্রিপেয়ার্ড !
রিক্সায় দুজন । জিসানের পড়নে খয়েরী রংয়ের পাঞ্জাবী আর ইরার পড়নে কালো রংয়ের শাড়ী । জিসান বলল ,
– আজ কি কোন স্পেশাল ডে ?
– না তো ।
– তাহলে শোক দিবস ?
– কেন ?
– কালো শাড়ী পড়লা যে ।
– কালো তো তোমার প্রিয় রং তাই ।
– এত আয়োজন কেন ?
– তুমি পাশে থাকলে আমার প্রতিটি দিনই স্পেশাল । তাই ।
– আর বোল না , বুকে চাপ লাগে ।
– আহা ঢং !
– উহু ভালোবাসা ! বাই দ্যা ওয়ে , আমরা যাচ্ছি কোথায় ?
– রেললাইনে ।
– কেন কেন ???
– মরতে !
– বাহ , মরার আগে কত্ত সাজুগুজু !
দুজনে হাসতে শুরু করল । রিক্সাওয়ালা বিরক্ত হয়ে গেছে তাদের হাসিতে । কিন্তু তাতে তাদের কোনই মাথা ব্যাথা নাই । তারা হাসতেই আছে তাদের মত ।
-৮
দুটি রেললাইন চলে গেছে অনেক দূর । দুইপাশে উচুঁ ইউক্যালিপ্টাস গাছের সারি । আকাশে হালকা মেঘ জমেছে । মৃদু বাতাস বইছে । বাতাসে ইরার সাড়ীর আচল আর চুল উড়ছে । জিসান মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে অপলক । একটু পর ইরা বলল ,
– এই শোন ।
– কি ?
– আমার হাত ধরতো ।
– ধরলে কি দিবা ?
– মাইর দিব । আরেহ বৌয়ের হাতের মাইর । কি সৌভাগ্য আমার !
– ঢং কোর না তো ? হাত ধরবা কিনা সেটা বল ?
– তা তো ধরতেই চাই , সেটা বলতে হয় নাকি !
দুই তরুণ তরুণী রেললাইনের উপর দিয়ে হাত ধরে হাটছে । মাঝে মাঝে তাল হারিয়ে পড়তে ধরলে আরেকজন তাকে ধরে ফেলছে । আকাশ ঘন কাল হয়ে আছে । কিছুক্ষণ পরই ঝুম বৃষ্টি শুরু হল । মেয়েটি আরো চঞ্চল হয়ে দুহাত প্রসারিত করে বৃষ্টিতে ভেজা শুরু করল । ছেলেটি পাশ থেকে বারণ করেই চলেছে । কিন্তু কে শোনে কার কথা । উপায় না দেখে ছেলেটি একটি কচুর নিয়ে মেয়েটির মাথার উপর ধরল । আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠল । ছেলেটি কিছু বোঝার আগেই দেখল মেয়েটি তাকে জড়িয়ে ধরেছে । ছেলের পুরো শরীরে কি এক সুখের অনুভূতি বয়ে গেল । হাত থেকে পড়ে গেল কচুর পাতা । তারা বৃষ্টি বিলাশে মগ্ন । মুখে তাদের বিশাল আনন্দ । পৃথিবী সর্বসুখী মানুষ এখন তারাই ।
নাহ জিসান আর ভাবতে চায়না । দৃষ্টি চায়ের কাপ থেকে ইরার দিকে নিয়ে গেল জিসান । মেয়েটির চোখ ভেজা । হাতে টিস্যু , কাদছে সে । কিন্তু জিসানের কোন ভ্রুক্ষেপ নাই । কারণ সে জানে , এই কাঁদাও , মেয়েদের চিরায়িত সেই রূপ , ছলনা !
-৯
৫ তলা দালান । এমডির রুম । সময় চলে যাচ্ছে । ইরা কিছুটা সামলে নিল নিজেকে । জিসানকে বলল ,
– কেমন আছো তুমি ?
– বেঁচে আছি । আপনি ?
– আমিও ওই আগের মত । ৫ বছর থেকে একি রকম !
– আপনাদেরই তো ভালো থাকার কথা ! তাই না ?
– খোঁটা দিচ্ছ ? আচ্ছা আমাকে আপনি করে বলছ কেন ?
– তুমি বলার অধিকার হারায় গেছে ?
– সেটা ফিরিয়ে আনার শক্তি কি তোমার নাই ?
– না নাই । আর থাকলেও চাই না । কারণ , এই পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে । একদল বড়লোক , অন্যদল অমানুষ । অমানুষকে বিধাতা কোন অধিকার বা অধিকারবোধ দেন না ।
ইরাকে দেখে মনে হচ্ছে সে অনেক কষ্টে কান্না চেপে আছে । এই মুখ দেখে জিসানের খুব ইচ্ছা হল ইরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে । কিন্তু কয়েকবছরে নিজের উপর নিয়ন্ত্রনটা খুব ভালোই শিখে গেছে জিসান । তাই নিজেকে সামলে নিল । ইরা আবার বলা শুরু করল ,
– একটা ছোট্ট রিক্যুয়েস্ট ?
– কোন রিক্যুয়েস্ট ফিলাপ করার মত ক্ষমতা আমার নাই ।
– আছে । আমি জানি । আমার ওই ডাকটা খুব শুনতে ইচ্ছা করতেছে ।
– কোনটা ?
– তুমি যেটা বলে আমায় ডাকতে , যেটা শুনে আমি গাল ফুলিয়ে বসে থাকতাম , যে ডাকের মাঝে মিশে থাকত তোমার অসীম ভালবাসার ছোঁয়া সেই ডাকটা ।
– দুঃখিত , বলতেই হচ্ছে , আপনি ভুল জানতেন ।
– কেন ?
– কারণ , ওই মেয়েটা মারা গেছে । যে নাই তাকে আর মনে করতে চাই না ।
– এত তারাতারি সে চলে গেল তোমার জীবন থেকে ?
– বাধ্য হয়েছি । অমানুষদের জন্য ভালবাসা নয় । তাদের কাজই হল ভালবাসাকে গলা টিপে মেরে ফেলা ।
ইরা কাঁদছে । হাউমাউ করে কাঁদছে । জিসান মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছে । সে ইরাবতীকে খুঁজে পাচ্ছে । তার ইরাবতী । যার চোখের প্রতিটি অশ্রুবিন্দুতেই জিসানের প্রতিবিম্ব থাকত । জিসান তাকিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে সেই গভীর ভেজা চোখে । কান্নাভরা , মায়াকারা দুটি চোখে ।
-১০
পার্কের ওই কোণাটার বেঞ্চে ইরা আর জিসান বসে আছে পাশাপাশি । ইরার মুখে কাল মেঘ জমে আছে । যেকোন মুহূর্তে বৃষ্টি হতে পারে । জিসান বলল ,
– এখন , কি করবা ?
– আমি কিছুই জানিনা ।
– তাহলে জানো কোনটা ?
– আমি তোমায় ছাড়া বাঁচবনা ।
নির্লিপ্ত কিন্তু আবেগ ভরা চোখে বলে দিল ইরা । দুজনে গম্ভীর হয়ে বসে আছে । ইরার বাবা বিশাল ধনবান । ঢাকার ধনী ব্যাক্তিদের মাঝে মোটামুটি তাকে ধরা যায় । তিনি এদের সম্পর্কের ব্যাপারে কোনভাবে জানতে পেরেছেন । তাই ঠিক করেছেন আগামী সপ্তাহের মাঝেই তার বন্ধুর ছেলের সাথে ইরার এনগেজমেন্ট করে রাখবেন ।
ইরা বলল ,
– দেখ , জিসান , বাবা এককথার মানুষ । তিনি যখন ঠিক করেছেন তার পছন্দের ছেলের সাথেই আমার বিয়ে দিবেন তখন তাই করবেন ।
– আমি কি করব এখন ? আমাদের একটু সাবধান হওয়া উচিৎ ছিল ।
– হুম । কিন্তু ওসব ভেবে এখন আর লাভ নাই । কি করব তাই বল ।
– আমার মাথায় কিছুই আসছেনা ।
– চল , পালিয়ে যাই ।
জিসান একটু হতচকিত হয়ে ইরার মুখের দিকে তাকাল । কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল ,
– সিওর তো ?
– হুম সিওর ।
– কিন্তু আমি তো বেকার !
– সোনা , তুমি যাই হও না কেন , আমি তোমাকেই বিয়ে করব । প্লিজ , ডোন্ট লিভ মি ।
পার্কে বসা দুটি তরুণ তরুণী খুব বিমর্ষ । মেয়েটি কাঁদছে । হাউমাউ করে কাঁদছে । ছেলেটি মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । মেয়েটি কাঁদছে । মেয়েটির চোখের পানিতে ছেলেটির শার্ট ভিজে গেছে । মেয়েটির অগোচরে ছেলেটি তার চোখের কোণে জমে থাকা জল মুছে ফেলে পরম ভালবাসায় মেয়েটিকে আরেকটু জোড়ে তার বুকের ভিতর জড়িয়ে ধরল । কি অদ্ভুদ এক ভালবাসা !
-১১
রাতের আকাশ । পূর্ণিমা তার রূপ ছড়িয়ে দিয়েছে । ট্রেইনের বগির দরজায় দুজন তরুণ তরুণী দাড়িয়ে আছে । ছেলেটি মেয়েটিকে গান শুনাচ্ছে ।
হঠাৎ এসেছিলে চোখের আলোতে , হারিয়ে ফেলেছি এক ঝলকে , তবুও তুমি ছিলে চোখের কোণে , আগলে রেখেছি বড় যতনে । ভালবেসেছি তোমাকে প্রথম চোখের আলোতে এসেছ যখন ছিলে হৃদয় জুড়ে প্রতিক্ষণে ভালবাসাতো হয়না মনের বিপরীতে ।
ট্রেইনের ঝম ঝম শব্দ গানের মাঝে রহস্যময় এক তাল এনে দিচ্ছে । গানের মধুরতা , ভালবাসার গভীরতা ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশের প্রকৃতিতে । মেয়েটি ছেলেটির কাধে মাথা দিয়ে মুগ্ধ হয়ে গান শুনছে । যাত্রীরা সবাই গভীর ঘুমে অচেতন । তরুণের গানের শ্রোতা তার প্রেমিকা , রাতের আকাশের চাঁদ , প্রকৃতি আর কিছু উড়ে চলা রাতজাগা পাখি । দুজনে ছেড়ে এসেছে তাদের পরিবার , বাবা-মা , আত্নীয় স্বজন । পিছুটানকে পিছু ফেলে ভালবাসাকে বুকে নিয়ে ছুটে চলছে তারা অজানার গন্তব্যে ।
-১২
সকালের দিকে তারা পৌঁছে গেল চট্টগ্রাম । এখানে ইরার কিছু দুঃসম্পর্কের কাজিন রয়েছে । নতুন পরিস্থিতি , নতুন সমাজ , নতুন আবহাওয়া । এসবের মাঝে গড়ে উঠবে তাদের নতুন জীবন । দুজনের কাছে যা ছিল তাতে মোটামুটি মাস চলে যাবে । ইরার কাজিন আর তার ফ্রেন্ডরা মিলে তাদের দুজনকে একটা বাসা ভাড়া করে দিল যদিও তাকে খুপরী বলাই ভালো । এবার তাদের বিয়ে । মোটামুটি হৈ হূলোর করেই কোর্ট ম্যারেজ হয়ে গেল তাদের । সেদিন সারাদিন তারা চট্টগ্রাম শহরটা ঘুরে দেখল । দারুণ মজা করল ।
শুরু হল তাদের নতুন জীবন । কিন্তু তারা কেউই জানতনা , এই নতুন জীবনেই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়ানক কিছু । যা তাদের দুজনেরই জীবনকে আমূল পাল্টে দেবে । জীবন হয়ে উঠবে বিভীষিকাময় ! জীবন হারাবে অনেক কিছু যা পূরণ করা আর সম্ভব হবে না , কখনই না । তারা যে নিজের অজান্তেই যোগ দিয়েছে কেড়ে নেয়ার খেলায় !
-১৩
ছোট্ট একটা সংসার । সারাদিন কোন কাজ নাই । খাও ঘুমাও আর ঘুরে বেড়াও । ভালোই যাচ্ছিল দিনগুলি । মাঝে মাঝে বাড়ীর কথা মনে পড়ে তাদের । কিন্তু মনকে শান্তনা দেয় এই ভেবে যে কয়েকমাস গেলেই পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যাবে । আর তাদের তো বিয়ে হয়েই গেছে । কেউ আর তাদের আলাদা করতে পারবে না । ভয় কিসের ! কিন্তু এদিকে জিসানের নতুন একটি চিন্তা মাথায় আসল । তাদের কাছে যা টাকা ছিল তা প্রায় শেষের দিকে , বাকি দিনগুলো কিভাবে চলবে তা ভেবে জিসান অস্থির হয়ে উঠল । ইরা দুঃশ্চিন্তা করবে বলে ইরাকে এর কিছুই জানায়নি জিসান । শুধু বলে রেখেছিল সে একটি চাকরী খুজছে তাই সে যেন টাকার ব্যাপারে কোন চিন্তা না করে । কিন্তু কথাগুলো জিসানের কানেই কেমন অসামঞ্জস্য লাগে । কারণ , সে জানে সে কত বড় বিপদে । সে মাত্র ইন্টার পাশ । এডমিশনের কোচিং করছে । তাকে কে চাকরী দিবে ? কিন্তু বাস্তবতা ইরার অজানা । সে ধনীর দুলালী । বাইরের জগৎ সম্পর্কে তার জ্ঞান শুণ্যের কোঠায় ।
ইরার কথায় জিসান ফিরে এল পুরনো সেই দিনগুলো থেকে ।
– দুপুরে আমার সাথে লাঞ্চ করবে প্লিজ ?
– দুঃখিত , মেসে মিল দেয়া আছে ।
– একটা দিন প্লিজ জিসান ?
– না থাক , বাদ দিন । আমার খাওয়া না খাওয়ায় কিছু যায় আসবে না ।
– এতটাই ঘৃণা কর আমাকে যে একবেলা লাঞ্চও করতে পারবেনা ?
– ছিঃ কি বলছেন ? আমার আবার ঘৃণা করা মানায়না ।
ইরা কাঁদছে । নিরবে কাঁদছে । হয়ত বুঝতে পেরেছে সামনে বসা এই মানুষটি রক্তে মাংসে গড়া হলেও ভিতরটা তার পাথরে পরিণত হয়েছে ।
-১৪
– তারপর , আপনি তো বিরাট মানুষ এখন । বিশাল এক কোম্পানীর এমডি । বাহ !
– আমাকে কিছুই করতে হয়নি । বাবার কোম্পানী । একটা আমি দেখছি ।
– কি সৌভাগ্য আমার ! মালিকের সাথে বসে গল্প করছি !
– টিটকারী করছ ?
– আরে কি যে বলেন । ধনী হওয়া বিধাতার আশীর্বাদ । আপ্নি সেই আশীর্বাদ জন্ম থেকে প্রাপ্ত ।
– তুমি অনেক পাল্টে গেছ । শারীরিক মানষিক দুটোই ।
– অভিযোজন করে নিয়েছি ।
অভিযোজন কথাটা শুনে ইরার মনে পড়ল জিসান খুব খুশি খুশি গলায় বাসায় এসে বলেছিল আজ সে নিজের টাকায় বাজার করেছে । কিন্তু টাকার কথা জিজ্ঞেস করলে কোন কথাই বলছিলনা । শেষে খুব পীড়াপীড়ীর পর ইরা যা জানতে পারল তাতে সে আকাশ থেকে পড়ল । জিসান শিপইয়ার্ডে চাকরী নিয়েছে । পার্ট টাইম লেবার । জাহাজের মাল খালাশ করে !!! শুনে ইরা অনেক কেঁদেছিল । তখন জিসান ইরাকে সান্তনা দেয়ার জন্য বলেছিল , – মাই ডিয়ার ইরাবতী , ডোন্ট ওরী , অভিযোজন করে নিচ্ছি তো । একদম সমস্যা হবেনা । ওই কান্নার মাঝেও ইরার মুখে হাসি এসেছিল । এরপর থেকে সে নিজেকে পার্ট টাইম লেবারের স্ত্রী হিসেবেই পরিচয় দিত । তার কখনই নিজেকে ছোট মনে হয়নি । কারণ , তার জিসান তার জন্য কত কষ্ট করছে , আর সে নিজেকে এতটুকু মানিয়ে নিতে পারবেনা তা কি হয় ! নিজেকে তার ছোট মনে হয়নি বরং গর্বিত মনে হত । পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী এবং ভাগ্যবতী নারী হিসেবে দাবী করতেও কুন্ঠিত হত না সে ।
-১৫
জিসান বরাবর খুব মেধাবী ছিল । সে তো এখন আর লেখাপড়া করতে পারবেনা তাই চাইছিল ইরা যেন লেখাপড়াটা চালিয়ে যায় । তাই সে নিজেই ইরাকে পড়াত । যদিও জিসান আর ইরা ক্লাশমেট তবুও জিসান এতটাই মেধাবী ছিল যে , ইরাকে সে অনায়াসেই সব বুঝিয়ে দিত ।
এভাবে চলে গেল প্রায় এক মাস । দিন দিন বাড়ীর প্রতি তাদের টান বাড়তে লাগল । জিসান বুঝতে পারে , সে পুরুষ , কষ্ট সহ্য করা তার জন্মগত বৈশিষ্ট্য । কিন্তু তার ইরাবতী তো জীবনে এত কষ্ট করেনি । বাবা মাকে ছেড়ে এতদিন বাইরেও থাকেনি । তার বোধয় খুব কষ্ট হচ্ছে । হয়ত তাকে বলছে না । কিন্তু তাতে কি ! সে তো তাকে হেল্প করতে পারে ।
– হ্যাঁ বাবা ? আমি ইরা ? কেমন আছো তুমি ?
ইরা ফোনে কথা বলছে । জিসান পাশে থেকে দেখছে । ইরার মুখে সুপ্ত আনন্দের ঝলক । খুশিতে উদ্ভাসিত মুখ । অনেকদিন পর পরিবারের সাথে কথা বলার খুশি । এইত চেয়েছিল জিসান তার ইরাবতী খুশি থাকুক সবসময় । কিন্তু ? ইরার মুখে কালো ছায়া নেমে আসল কেন ? ইরা জিসানের দিকে তাকাল । তার চোখ ছল ছল করছে । হাত কাঁপছে থর থর করে । জিসানের বুকটা ধ্বক করে উঠল ইরার এই অবস্থা দেখে । বুকের ভিতরটা অজানা আশংকায় কেপে উঠেছিল জিসানের ।
-১৬
৫ তলা দালানের সেই এমডি রুম । ইরা জিসান সামনাসামনি বসে আছে । এর মাঝে দুই বার তার পিএস এসে নক করেছে । কিন্তু ইরা ডিস্টার্ব করতে নিষেধ করে দিয়েছে । ইরার চোখ লাল টসটসে হয়ে আছে । সে শুধুই ভাবছে , একটা মানুষ কতটা কষ্ট পেলে এমন পাথর হয়ে যায় ! অনুভূতির ডেপো বলে খ্যাত জিসানের মাঝে আর একফোঁটা অনুভূতি অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয়না । যা আছে সব অভিমান ! কিন্তু কার উপর এই অভিমান ? তার উপর ? সে তো জিসানকে ভালোবাসে । এখনও ভালবাসে । আগের মতই ভালবাসে । সে তো সব সময় জিসানের ভালোই চেয়েছে । কিন্তু তারপরেও এত অভিমান কেন ? সেও তো অভিমান করতে পারত । এই ৫ বছরে একবারও জিসান তার খোঁজ নেয়নি । কেন ? হাজারটা প্রশ্ন আর একবুক কষ্ট নিয়ে তাকিয়ে থাকে ইরা জিসানের দিকে ।
কিন্তু বিধাতা হয়ত চাননি জিসানের জীবনের ট্রাজেডিগুলো ইরা জেনে থাক । কারণ বিধাতা মাঝে মাঝে দুটি জীবনকে নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন !!!
-১৭
ভালবাসা জিনিসটা মানুষের মনে থেকে যায় চিরতরে । হারিয়ে যায়না তার অস্তিত্ব । কিন্তু হারিয়ে যায় তার বহিঃপ্রকাশ । যেমনটি হয়েছে জিসানের । ইরার প্রতি তার ভালবাসা আগের মতই আছে । কিন্তু জিসান চায়না তার প্রকাশ ঘটুক । কারণ যার প্রকাশে জীবন পাল্টে যায় তার প্রকাশ না হওয়াই ভালো ।
চট্টগ্রাম সীপোর্ট থেকে কয়েক কিমি দূরে একটি ছোট্ট ঘর । বাবার সাথে কথা বলা শেষ করতে পারল না । কেঁদে চোখের জল নাকের জল এক করে ফেলেছে । জিসান বুঝতে পারছিলনা কি ঘটেছে । ইরাকে জিজ্ঞাসা করলে সে শুধু দুটি কথাই বলল , জিসান তোমার খুব বিপদ , আমাদের আজই ঢাকা যেতে হবে । প্লিজ আমাকে মাফ করে দিও । এর বেশী ইরা আর কিছুই বলল না । সেদিন রাতেই তারা ঢাকায় রওনা দেয় । পিছনে ফেলে তাদের শখের , স্বপ্নের , ভালোবাসা দিয়ে গড়া সংসার !
-১৮
সারারাত ইরা কাটিয়েছে কেঁদে আর জিসান কাটিয়েছে টেনশনে । ইরা তাকে কিছুই বলছিল না । বাসস্ট্যান্ডে নামতেই ঘটনা কিছুটা বুঝল জিসান । ঘটনাগুলো যেন কোন পরাবাস্তব দুনিয়ায় ঘটে যাচ্ছে যেখানে তার কিছুই করার নাই শুধু দেখা ছাড়া ।
পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গেল । ৩ টা কেসঃ নারী নির্যাতন , অপহরণ , বাল্যবিবাহ । প্রধান আসামী জিসান , দ্বিতীয় আসামী তার বাবা মা , ৩য় তার আত্নীয়রা ! প্রত্যেকেই নজরবন্দী । জিসান দেখতে পারে টাকার ক্ষমতা যে ক্ষমতার কাছে সব তুচ্ছ ! কিন্তু তার আরো অনেক কিছুই দেখার বাকী ছিল তখনও ।
আপাতত তাদের একটা জবানবন্দী নেয় পুলিশ । তাতে দুইজনের কথা মিলে যায় । ইরা জিসান দুইজনের মনেই আশার আলো জ্বলে ওঠে এই ভেবে যে তাদের আর কেউ আলাদা করতে পারবে না । আহা তারা যদি বাস্তবতার কালো পর্দার আড়ালের জগত্টা চিনত । দুপুরের আগেই ইরার বাবা ইরাকে নিয়ে যায় । কিন্তু আইনের প্যাঁচে জিসান থেকে যায় জেলেই । পুলিশ বলে দেয় কাল তাকে কোর্টে চালান করে দেয়া হবে যেখান থেকে শুরু হবে জিসানের আরেকটি জীবন ।
-১৯
ইরা দাড়িয়ে আছে জিসানের মুখোমুখি । ঠিক সামনের এজলাশে । এখন ইরার সাক্ষী । ইরা নির্বিকার মুখে বলা যা বলল , তাতে জিসান যতটা অবাক হল , তার জীবনে সে অতটা অবাক হয়নি । সে সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল । এটা কি ঠিক শুনল জিসান ? ইরাকে সে জোড় করে উঠিয়ে নিয়ে গেছে ! তাকে জোড় করে বিয়ে করেছে ! এই ভালোবাসে ইরাবতী তাকে ! জিসানের সামনের সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল । সে আর কিছুই বলল না । মনে মনে ঠিক করে নিল জিসান , এতে যদি তার ইরাবতী সুখে থাকে তবে তাই হোক ! বরং তারই বা কি যোগ্যতা আছে এত বড়লোকের মেয়ের সাথে সংসার করার ! মাথা নিচু করে ফেলল সে । আর তাকাতে চায়না সে ইরার দিকে । পায়ের কাছে পড়ে থাকা ধুলোবালি গুলো কোন এক মানুষের অশ্রুজলে সিক্ত হতে থাকে । সেই অশ্রুজলধারাও যেন সেখানে ইরাবতীর ছবি একে দিচ্ছে !
-২০
আজ জিসানের রায় হবে । আজ ইরাও চলে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া । তার কিছুই করার নাই । সে নিরুপায় । তার কানে এখন বাজছে বাবার সেই কথাগুলো , তুমি সত্য বললেও কিছু হবে না , মিথ্যা বললেও কিছু হবে না । কারণ আমার ক্ষমতার দৌড় অনেক । তবে তুমি যদি মিথ্যা বল তাহলে হয়ত ওই শুয়োরের বাপ মা বেঁচে যাবে ! তবে তুমি যদি বিদেশ চলে যাও তবে আমি জিসানকে বাঁচাতে পারি ! ইরার পুরো শরীর হীম হয়ে আসছে ! সে এটা কি করল ! কিভাবে করতে পারল এটা ! হোক , তবুও যদি , জিসানের বাবা মা ভালো থাকে তবে সে সার্থক । জিসান হয়ত কোনদিন তাকে মাফ করবে না । কিন্তু সে তো তার ভালোর জন্যই এতগুলো মিথ্যা বলল , এতগুলো ত্যাগকে স্বীকার করল ! এটাই তো ভালোবাসা , প্রকৃত ভালোবাসা ! সে জিসানকে সত্যি ভালোবাসে , অনেক ভালবাসে !
কাঁদছেন কেন আপনি ? – জিসানের কথায় ইরা ফিরে এল সেই বিভীষীকাময় দিনগুলো থেকে বর্তমানে । জিসানের চোখের দিকে তাকাল । আস্তে আস্তে , খুব নিচু গলায় বলল ,
– আমাকে মাফ করে দিতে পারো না ?
– ছিঃ এসব কি বলছেন ? আমি মাফ করার কে ? আর আপনি যা করেছেন তা ভালোর জন্যই করেছেন ! তা না করলে আজ তো আপনি আর এই চেয়ারে বসতে পারতেন না ! আপনাকে থাকতে হত এক গরীব লেবারের বৌ হিসেবে !
– আমি কিন্তু এখনও তোমার স্ত্রী !
– হা হা হা ! এই কথাটা ৫ বছর পর মনে পড়ল হঠাৎ ???
– প্লিজ আমায় ভুল বুঝো না । আমি অস্ট্রেলিয়া ছিলাম । ফিরে এসে তোমাদের বাসায় গেছিলাম কিন্তু তোমরা ওখানে ছিলে না !
– থাকতে পারিনি ম্যাডাম ! আপনি কি জানেন আমার তিন বছর জেলের রায় হয়েছিল ! আমার পরিবার তার সর্বস্ব দিয়ে আমায় ছাড়িয়ে এনেছে । যদিও আমাকে ১১ মাস জেলে থাকতে হয়েছে ! এরপর আমরা চলে আসি দেশের বাড়ীতে ।
ইরার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল সে যেকোন মুহূর্তে চিৎকার করে কেঁদে উঠবে !
ভারী গলায় বলল ,
– মা বাবা ভালো আছেন ?
– মা বেঁচে আছেন , বাবা নেই । আমি জেল থেকে বেড় হবার পরের বছর মারা গেছেন ।
(২১)
৫ তলা দালান । এমডির রুম । এক যুবক মাথা নিচু করে বসে আছে । এক যুবতী যুবকের পায়ের কাছে হাউমাউ করে কাঁদছে । চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে সেই যুবককে বলছে , আমাকে প্লিজ মাফ করে দাও । আমি নিরুপায় ছিলাম । আমি যদি তা না করতাম তবে মা বাবা কেও জেলে যেতে হত ! প্লিজ আমার সাথে এত রুড হইয়ো না । চল প্লিজ আমরা নতুন করে সবকিছু শুরু করি ।
– যে তীর ছোঁড়া হয় তা যেমন ফিরে আসেনা যে অতীত যায় সেটাও আর নতুন হয় না । আমি মাটির মানুষ , আমার চাঁদে হাত দেয়া অপরাধ ম্যাডাম !
ইরাবতী জিসানের পা জড়িয়ে ইরাবতী নদীর ন্যায় চোখের জল ফেলছে ! জিসানের চোখ ভিজে গেল । বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠল । বুঝতে পারল , এখানে থাকা তার উচিৎ হবেনা ! টলমল পায়ে উঠে দাড়াল জিসান । হাটা ধরল দরজার দিকে । মেঝেতে পড়ে ডুকড়ে ডুকড়ে কাঁদছে তার ইরাবতী । জিসান নিজেকে আটকাতে পারেনা । চোখের পানিতে ভিজিয়ে ফেলে শার্ট ! দরজা খুলে বেড় হয়ে আসে সে । পিছনে ফেলে আসে তার জীবনের চাইতেও বেশীকিছু । সিলিংয়ের দিকে মুখ করে বলে , বিধাতা , তুমি যদি সত্যি থেকে থাকো , তবে পৃথিবীর সকল প্রেমিকের অদ্বিতীয়াকে সুখে রেখ !
জিসান হাটছে । পিছনে তাকাচ্ছেনা সে পাছে পিছুটান চলে আসে !