Real Love Story – সত্যিকারের ভালোবাসা।

পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

– জ্বী , আমি জিসান ।

 

– আপনাকে আমাদের এমডি ডাকছেন ।

 

– আমাকে ? এমডি ?? কেন ?

 

– সেটা তো জানি না ।

 

– আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে হয়ত ।

 

– না ঠিকই আছে । আপনি আসুন আমার সাথে ।

 

মনে হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে জিসান হাটা শুরু করল । সে জানতনা তার জন্য ওখানে তিনটা চমক অপেক্ষা করছে । যা আবার তাকে রোহমন্থন করে দিবে সাত বছর আগের সেই দিনগুলি ।

 

-৩

Real Love Story - সত্যিকারের ভালোবাসা।

Real Love Story – সত্যিকারের ভালোবাসা।

বাংলা মিষ্টি প্রেমের গল্প | Romantic Love Story

 

জিসান ৫ তলায় চলে আসল । জায়গাটা ভীষণ সুন্দর , দেখলেই মন ভালো হয়ে যাবে । বোঝাই যায় এমডি অনেক সৌখিন মানুষ । লোকটি জিসানকে এমডির রুম দেখিয়ে দিল । দরজা ঠেলা দিতেই হালকা এয়ারফ্রেশনারের গন্ধ নাকে লাগল । এমডির দিকে চাইতেই প্রথম চমক পেয়ে গেল জিসান । এমডি একজন মহিলা । তিনি মাথা নিচু করে খুব মনযোগ দিয়ে কিছু পড়ছেন । জিসান বলল , আসব ম্যাডাম ?

 

মুখ না তুলেই তিনি বললেন plz come ।

 

কন্ঠস্বরটা শুনেই জিসানের বুকের ভিতরটা ধ্বক করে উঠল । অদ্ভুত মিল এই কন্ঠস্বরের । হুবহু এক । দ্বিতীয় চমক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই জিসান তৃতীয় চমক পেয়ে গেল । সেই এমডি ম্যাডাম মুখ তুলে চেয়েছেন । মুখের অবয়বটা দেখে জিসানের পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেল । পুরা দুনিয়া ঘুরতে লাগল চোখের সামনে । মাটিতে পতনের হাত থেকে বাঁচতে কোনমতে দেয়াল ধরে তাল সামলাল । সেই মুখ , সেই মায়াকারা চোখ , সেই ঠোঁট , সেই এলোমেলো চুল , সেই চাহনী । সব আগের মতই আছে । সাত বছরেও যার পরিবর্তন হয়নি শুধু চোখে একটা গোলাপী ফ্রেমের ছশমা যোগ হয়েছে । জিসানের মুখ দিয়ে আনমনেই একটি শব্দই বেড় হয়ে আসল ।  ইরাবতী  । এ যে তার ইরাবতী !

 

-৪

Real Love Story – সত্যিকারের ভালোবাসা।

ট্রেইনের ঝম ঝম শব্দ হচ্ছে । রাতের আকাশের পূর্ণিমা ট্রেইনের বগির দরজায় দাড়িয়ে উপভোগ করছে দুইজন তরুণ তরুণী । ছেলেটি অনর্গল কথা বলে চলছে আর মেয়েটি লাজুক লাজুক মুখে তা শুনছে , আর মাঝে মাঝে কিসব প্রতিবাদ করে উঠছে । উঠতি এই যুবক যুবতীকে দেখলে মনেই হবেনা তারা বাড়ী থেকে পালিয়ে এসেছে । ট্রেইনটি একটা লোহার ব্রীজ ক্রস করল । ঝম ঝম শব্দটি গুম গুম শব্দে রূপ নিল । হঠাৎ শব্দের এই পরিবর্তনে মেয়েটি ভয় পেয়ে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরল । ছেলেটি হাসিমাখা মুখে বলল ,

 

– মাই ডিয়ার ইরাবতী কি ভয় পেয়েছে ?

 

– খবরদার আমাকে ইরাবতী বলবা না । আমার নাম ইরা ।

 

– ওই হইল , ওইটা আদরের ডাক ।

 

– আহারে আমার আদর ! ঢং !

 

– আহা শোননা । যদি এরকম লোহার কালভার্ট গুলো প্রতি ১০০ মিটার পর পর থাকত তবে কি হত জানো ?

 

– কি হত ?

 

– তুমি ভয় পেয়ে বারবার আমায় জড়িয়ে ধরতে ।

 

সাথে সাথে ইরা জিসানকে ছেড়ে দিয়ে বলল ,

 

– বেয়াদপ কোথাকার !

 

– প্রাউড টু বি !

 

– তোমার লজ্জা হবে না কোনদিন ।

 

– লজ্জা থাকলে তো আর প্রেম করা যায়না গো ডিয়ার ইরাবতী ।

 

– আবার !

 

বলেই ইরা আহ্লাদী গলায় জিসানকে জড়িয়ে ধরল । জিসানও গভীর ভালবাসায় ইরার মাথায় মাথা রাখল ।

 

রাত বাড়ছে । ঝম ঝম ট্রেইনের শব্দটা প্রকট হয়েছে । রাতের প্রকৃতিতে জিসান আর ইরার ভালবাসা ছড়িয়ে দিচ্ছে এক অদ্ভুৎ সৌন্দর্য ! অদ্ভুত এক ভালোবাসার গন্ধে সুরভিত রাতের বাতাস ।

 

কি হল ? ওখানেই দাড়ায় থাকবা ?

 

ইরার কথা শুনে জিসান ফিরে এল ছয় বছর আগের স্বপ্নময় দিনগুলো থেকে । টলমল পায়ে এগিয়ে গেল টেবিলের দিলে । ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে । এইত , তার ইরাবতী তার সামনেই । একদম মুখোমুখী । তারই ইরাবতী !

 

-৫

 

রুমের ভিতর পিনপতন নিরবতা । এসির মৃদু শব্দটাও কানে বাজছে । ইরা চুপচাপ বসে আছে । জিসানের হতভম্ভ ভাব কাটেনি । এই গম্ভীর পরিবেশ দূর করার জন্য ইরা বলে উঠল ,

 

– ইন্টারভিউ কেমন হল তোমার ?

 

– বরাবর যেমন হয় ।

 

– মানে ?

 

– ভালোই ।

 

– ও আচ্ছা ।

 

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ইরা আবার বলল ,

 

– চা খাবে নাকি কফি ?

 

– কফি খাই না । অত টাকা কই পাব ? চাই ভাল ।

 

ইরা কিছু না বলে চা আনতে বলল । জিসান ভাবছে এই ইরা আর আগের ইরার মাঝে কোন মিল নেই । থাকবেই বা কিভাবে । সে তো ছিল ইরাবতী , তার ইরাবতী । আর ইনি , গুরুগম্ভীর , কর্পোরেট ইরা । জিসানের ইরাবতী তো ছিল দুরন্ত । ইরাবতী নদীর স্রোতের মতই যাকে দমিয়ে রাখা ছিল অসম্ভব । চঞ্চল চোখ , বাধ ভাঙ্গা উল্লাস মনে কোন কষ্টকেই আসতে দিতনা । যার চঞ্চলতায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হত বারবার । বারবার বলতে ইচ্ছা হত  ভালবাসি , ভালবাসি এবং ভালবাসি  ।

 

ভাবনাগুলো গভীর থেকে গভীরে চলে যাচ্ছিল । কিন্তু জিসান নিজেকে সামলে নিল পুরোন স্মৃতি রোহমন্থন করা থেকে । জিসান নিরবতা ভাঙ্গার চেষ্টা করল । একটু সংকুচিত হয়ে ইরার সাথে কথা বলা শুরু করল ।

 

 

-৬

 

– আমাকে চিনলে কিভাবে ? মানে বুঝলেন কিভাবে বুঝলেন ?

 

একটু সময় নিয়ে ইরা বলল ,

 

– বললে কি বিশ্বাস করবে ?

 

– বিশ্বাস জিনিসটাকেই আমি বিশ্বাস করিনা । সমস্যা নাই । আপনি বলুন ।

 

– তোমায় অনেক খুঁজেছি । পাগলের মত খুঁজেছি । পরশু ক্যান্ডিডেটদের লিস্টগুলো দেখছিলাম । সেখানেই তোমাকে পাই । আজ সকাল ৯ টা থেকে তোমাকে দেখার জন্য জানালার পাশে বসে আছি ।

 

– বাহ বাহ । আমার তো রাজকপাল । কোম্পানীর একজন এমডি আমার জন্য সব কাজ ফেলে দুই ঘন্টা জানালার পাশে বসে ছিলেন ।

 

বলেই জিসান অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল । দ্রুতই নিজেকে সামলে নিল । ইরাকে হাসির জন্য স্যরি বলতে যাবে তখন দেখতে পেল ইরার মুখে গভীর বিষাদের ছায়া । জিসান বুঝতে পারলনা এটা আসলেই বিষাদ নাকি নারীদের চিরায়িত রূপ , ছলনা ।

 

চা এসে গেছে । জিসান চা খাচ্ছে না । এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চায়ের দিকে । ইরা বলল ,

 

– কি হল ? চা নাও ।

 

– চা টার ভিতরে সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে । বড়লোকের চা তো সুন্দর হবেই । এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে ইচ্ছা করছে । চা খেলেই তো সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে । বেঁচে থাকুক সৌন্দর্য ।

 

চায়ের খয়েরী রংয়ের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে জিসান । খয়েরী রং যে তার খুব প্রিয় । এই রংয়েই আছে কত স্মৃতি ।

 

-৭

 

সেদিন শুক্রবার । ইরার সাথে স্পেশাল দেখা করার ডেট । দেখার আবার স্পেশাল কি জিসান বুঝতে পারছে না । মেয়েটা মাঝে মাঝে এত রহস্য করে বলাই বাহুল্য । তারাতারি ফ্রেশ হয়ে কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মাকে কোচিংয়ের কথা বলে বের হল জিসান ।

 

পার্কের এই কোণাটা ওদের অলিখিত সম্পত্তি । কেউ এসে এদিকে বসে না । গত তিন বছর ধরেই তারা এভাবে এখানে দেখা করে আসছে । ইরা বসে আছে । হাতে দুটো প্যাকেট । কাছে যেতেই ইরা বলল ,

 

– মহারাজের আসার সময় হল তাহলে ।

 

– মাই ডিয়ার ইরাবতী , আমি রাইট টাইমেই আসছি । তুমি ই একটু ফাস্ট হয়ে গেছ ।

 

– উফ ! এই নামটা বলবা নাতো । চল , কাজ আছে ।

 

– কোথায় ?

 

– গেলেই বুঝতে পারবে ।

 

– যথ আজ্ঞা মাই ডিয়ার .…

 

– চুপ !

 

দুজনে একটি শপিং মলে আসল । জিসানের হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ইরা বলল ,

 

– যাও , এইটা পড়ে আস ।

 

– কি এইটা ?

 

– যা আছে আছে । যাও তাড়াতাড়ি । আমিও change করে আসছি ।

 

– বাপরে ! ফুল প্রিপেয়ার্ড !

 

রিক্সায় দুজন । জিসানের পড়নে খয়েরী রংয়ের পাঞ্জাবী আর ইরার পড়নে কালো রংয়ের শাড়ী । জিসান বলল ,

 

– আজ কি কোন স্পেশাল ডে ?

 

– না তো ।

 

– তাহলে শোক দিবস ?

 

– কেন ?

 

– কালো শাড়ী পড়লা যে ।

 

– কালো তো তোমার প্রিয় রং তাই ।

 

– এত আয়োজন কেন ?

 

– তুমি পাশে থাকলে আমার প্রতিটি দিনই স্পেশাল । তাই ।

 

– আর বোল না , বুকে চাপ লাগে ।

 

– আহা ঢং !

 

– উহু ভালোবাসা ! বাই দ্যা ওয়ে , আমরা যাচ্ছি কোথায় ?

 

– রেললাইনে ।

 

– কেন কেন ???

 

– মরতে !

 

– বাহ , মরার আগে কত্ত সাজুগুজু !

 

দুজনে হাসতে শুরু করল । রিক্সাওয়ালা বিরক্ত হয়ে গেছে তাদের হাসিতে । কিন্তু তাতে তাদের কোনই মাথা ব্যাথা নাই । তারা হাসতেই আছে তাদের মত ।

 

 

 

-৮

 

দুটি রেললাইন চলে গেছে অনেক দূর । দুইপাশে উচুঁ ইউক্যালিপ্টাস গাছের সারি । আকাশে হালকা মেঘ জমেছে । মৃদু বাতাস বইছে । বাতাসে ইরার সাড়ীর আচল আর চুল উড়ছে । জিসান মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে অপলক । একটু পর ইরা বলল ,

 

– এই শোন ।

 

– কি ?

 

– আমার হাত ধরতো ।

 

– ধরলে কি দিবা ?

 

– মাইর দিব । আরেহ বৌয়ের হাতের মাইর । কি সৌভাগ্য আমার !

 

– ঢং কোর না তো ? হাত ধরবা কিনা সেটা বল ?

 

– তা তো ধরতেই চাই , সেটা বলতে হয় নাকি !

 

দুই তরুণ তরুণী রেললাইনের উপর দিয়ে হাত ধরে হাটছে । মাঝে মাঝে তাল হারিয়ে পড়তে ধরলে আরেকজন তাকে ধরে ফেলছে । আকাশ ঘন কাল হয়ে আছে । কিছুক্ষণ পরই ঝুম বৃষ্টি শুরু হল । মেয়েটি আরো চঞ্চল হয়ে দুহাত প্রসারিত করে বৃষ্টিতে ভেজা শুরু করল । ছেলেটি পাশ থেকে বারণ করেই চলেছে । কিন্তু কে শোনে কার কথা । উপায় না দেখে ছেলেটি একটি কচুর নিয়ে মেয়েটির মাথার উপর ধরল । আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠল । ছেলেটি কিছু বোঝার আগেই দেখল মেয়েটি তাকে জড়িয়ে ধরেছে । ছেলের পুরো শরীরে কি এক সুখের অনুভূতি বয়ে গেল । হাত থেকে পড়ে গেল কচুর পাতা । তারা বৃষ্টি বিলাশে মগ্ন । মুখে তাদের বিশাল আনন্দ । পৃথিবী সর্বসুখী মানুষ এখন তারাই ।

 

নাহ জিসান আর ভাবতে চায়না । দৃষ্টি চায়ের কাপ থেকে ইরার দিকে নিয়ে গেল জিসান । মেয়েটির চোখ ভেজা । হাতে টিস্যু , কাদছে সে । কিন্তু জিসানের কোন ভ্রুক্ষেপ নাই । কারণ সে জানে , এই কাঁদাও , মেয়েদের চিরায়িত সেই রূপ , ছলনা !

 

-৯

 

৫ তলা দালান । এমডির রুম । সময় চলে যাচ্ছে । ইরা কিছুটা সামলে নিল নিজেকে । জিসানকে বলল ,

 

– কেমন আছো তুমি ?

 

– বেঁচে আছি । আপনি ?

 

– আমিও ওই আগের মত । ৫ বছর থেকে একি রকম !

 

– আপনাদেরই তো ভালো থাকার কথা ! তাই না ?

 

– খোঁটা দিচ্ছ ? আচ্ছা আমাকে আপনি করে বলছ কেন ?

 

– তুমি বলার অধিকার হারায় গেছে ?

 

– সেটা ফিরিয়ে আনার শক্তি কি তোমার নাই ?

 

– না নাই । আর থাকলেও চাই না । কারণ , এই পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে । একদল বড়লোক , অন্যদল অমানুষ । অমানুষকে বিধাতা কোন অধিকার বা অধিকারবোধ দেন না ।

 

ইরাকে দেখে মনে হচ্ছে সে অনেক কষ্টে কান্না চেপে আছে । এই মুখ দেখে জিসানের খুব ইচ্ছা হল ইরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে । কিন্তু কয়েকবছরে নিজের উপর নিয়ন্ত্রনটা খুব ভালোই শিখে গেছে জিসান । তাই নিজেকে সামলে নিল । ইরা আবার বলা শুরু করল ,

 

– একটা ছোট্ট রিক্যুয়েস্ট ?

 

– কোন রিক্যুয়েস্ট ফিলাপ করার মত ক্ষমতা আমার নাই ।

 

– আছে । আমি জানি । আমার ওই ডাকটা খুব শুনতে ইচ্ছা করতেছে ।

 

– কোনটা ?

 

– তুমি যেটা বলে আমায় ডাকতে , যেটা শুনে আমি গাল ফুলিয়ে বসে থাকতাম , যে ডাকের মাঝে মিশে থাকত তোমার অসীম ভালবাসার ছোঁয়া সেই ডাকটা ।

 

– দুঃখিত , বলতেই হচ্ছে , আপনি ভুল জানতেন ।

 

– কেন ?

 

– কারণ , ওই মেয়েটা মারা গেছে । যে নাই তাকে আর মনে করতে চাই না ।

 

– এত তারাতারি সে চলে গেল তোমার জীবন থেকে ?

 

– বাধ্য হয়েছি । অমানুষদের জন্য ভালবাসা নয় । তাদের কাজই হল ভালবাসাকে গলা টিপে মেরে ফেলা ।

 

ইরা কাঁদছে । হাউমাউ করে কাঁদছে । জিসান মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছে । সে ইরাবতীকে খুঁজে পাচ্ছে । তার ইরাবতী । যার চোখের প্রতিটি অশ্রুবিন্দুতেই জিসানের প্রতিবিম্ব থাকত । জিসান তাকিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে সেই গভীর ভেজা চোখে । কান্নাভরা , মায়াকারা দুটি চোখে ।

 

 

-১০

 

পার্কের ওই কোণাটার বেঞ্চে ইরা আর জিসান বসে আছে পাশাপাশি । ইরার মুখে কাল মেঘ জমে আছে । যেকোন মুহূর্তে বৃষ্টি হতে পারে । জিসান বলল ,

 

– এখন , কি করবা ?

 

– আমি কিছুই জানিনা ।

 

– তাহলে জানো কোনটা ?

 

– আমি তোমায় ছাড়া বাঁচবনা ।

 

নির্লিপ্ত কিন্তু আবেগ ভরা চোখে বলে দিল ইরা । দুজনে গম্ভীর হয়ে বসে আছে । ইরার বাবা বিশাল ধনবান । ঢাকার ধনী ব্যাক্তিদের মাঝে মোটামুটি তাকে ধরা যায় । তিনি এদের সম্পর্কের ব্যাপারে কোনভাবে জানতে পেরেছেন । তাই ঠিক করেছেন আগামী সপ্তাহের মাঝেই তার বন্ধুর ছেলের সাথে ইরার এনগেজমেন্ট করে রাখবেন ।

 

ইরা বলল ,

 

– দেখ , জিসান , বাবা এককথার মানুষ । তিনি যখন ঠিক করেছেন তার পছন্দের ছেলের সাথেই আমার বিয়ে দিবেন তখন তাই করবেন ।

 

– আমি কি করব এখন ? আমাদের একটু সাবধান হওয়া উচিৎ ছিল ।

 

– হুম । কিন্তু ওসব ভেবে এখন আর লাভ নাই । কি করব তাই বল ।

 

– আমার মাথায় কিছুই আসছেনা ।

 

– চল , পালিয়ে যাই ।

 

জিসান একটু হতচকিত হয়ে ইরার মুখের দিকে তাকাল । কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল ,

 

– সিওর তো ?

 

– হুম সিওর ।

 

– কিন্তু আমি তো বেকার !

 

– সোনা , তুমি যাই হও না কেন , আমি তোমাকেই বিয়ে করব । প্লিজ , ডোন্ট লিভ মি ।

 

পার্কে বসা দুটি তরুণ তরুণী খুব বিমর্ষ । মেয়েটি কাঁদছে । হাউমাউ করে কাঁদছে । ছেলেটি মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । মেয়েটি কাঁদছে । মেয়েটির চোখের পানিতে ছেলেটির শার্ট ভিজে গেছে । মেয়েটির অগোচরে ছেলেটি তার চোখের কোণে জমে থাকা জল মুছে ফেলে পরম ভালবাসায় মেয়েটিকে আরেকটু জোড়ে তার বুকের ভিতর জড়িয়ে ধরল । কি অদ্ভুদ এক ভালবাসা !

 

-১১

 

রাতের আকাশ । পূর্ণিমা তার রূপ ছড়িয়ে দিয়েছে । ট্রেইনের বগির দরজায় দুজন তরুণ তরুণী দাড়িয়ে আছে । ছেলেটি মেয়েটিকে গান শুনাচ্ছে ।

 

হঠাৎ এসেছিলে চোখের আলোতে , হারিয়ে ফেলেছি এক ঝলকে , তবুও তুমি ছিলে চোখের কোণে , আগলে রেখেছি বড় যতনে । ভালবেসেছি তোমাকে প্রথম চোখের আলোতে এসেছ যখন ছিলে হৃদয় জুড়ে প্রতিক্ষণে ভালবাসাতো হয়না মনের বিপরীতে ।

 

ট্রেইনের ঝম ঝম শব্দ গানের মাঝে রহস্যময় এক তাল এনে দিচ্ছে । গানের মধুরতা , ভালবাসার গভীরতা ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশের প্রকৃতিতে । মেয়েটি ছেলেটির কাধে মাথা দিয়ে মুগ্ধ হয়ে গান শুনছে । যাত্রীরা সবাই গভীর ঘুমে অচেতন । তরুণের গানের শ্রোতা তার প্রেমিকা , রাতের আকাশের চাঁদ , প্রকৃতি আর কিছু উড়ে চলা রাতজাগা পাখি । দুজনে ছেড়ে এসেছে তাদের পরিবার , বাবা-মা , আত্নীয় স্বজন । পিছুটানকে পিছু ফেলে ভালবাসাকে বুকে নিয়ে ছুটে চলছে তারা অজানার গন্তব্যে ।

 

-১২

 

সকালের দিকে তারা পৌঁছে গেল চট্টগ্রাম । এখানে ইরার কিছু দুঃসম্পর্কের কাজিন রয়েছে । নতুন পরিস্থিতি , নতুন সমাজ , নতুন আবহাওয়া । এসবের মাঝে গড়ে উঠবে তাদের নতুন জীবন । দুজনের কাছে যা ছিল তাতে মোটামুটি মাস চলে যাবে । ইরার কাজিন আর তার ফ্রেন্ডরা মিলে তাদের দুজনকে একটা বাসা ভাড়া করে দিল যদিও তাকে খুপরী বলাই ভালো । এবার তাদের বিয়ে । মোটামুটি হৈ হূলোর করেই কোর্ট ম্যারেজ হয়ে গেল তাদের । সেদিন সারাদিন তারা চট্টগ্রাম শহরটা ঘুরে দেখল । দারুণ মজা করল ।

 

শুরু হল তাদের নতুন জীবন । কিন্তু তারা কেউই জানতনা , এই নতুন জীবনেই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়ানক কিছু । যা তাদের দুজনেরই জীবনকে আমূল পাল্টে দেবে । জীবন হয়ে উঠবে বিভীষিকাময় ! জীবন হারাবে অনেক কিছু যা পূরণ করা আর সম্ভব হবে না , কখনই না । তারা যে নিজের অজান্তেই যোগ দিয়েছে কেড়ে নেয়ার খেলায় !

 

-১৩

 

ছোট্ট একটা সংসার । সারাদিন কোন কাজ নাই । খাও ঘুমাও আর ঘুরে বেড়াও । ভালোই যাচ্ছিল দিনগুলি । মাঝে মাঝে বাড়ীর কথা মনে পড়ে তাদের । কিন্তু মনকে শান্তনা দেয় এই ভেবে যে কয়েকমাস গেলেই পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যাবে । আর তাদের তো বিয়ে হয়েই গেছে । কেউ আর তাদের আলাদা করতে পারবে না । ভয় কিসের ! কিন্তু এদিকে জিসানের নতুন একটি চিন্তা মাথায় আসল । তাদের কাছে যা টাকা ছিল তা প্রায় শেষের দিকে , বাকি দিনগুলো কিভাবে চলবে তা ভেবে জিসান অস্থির হয়ে উঠল । ইরা দুঃশ্চিন্তা করবে বলে ইরাকে এর কিছুই জানায়নি জিসান । শুধু বলে রেখেছিল সে একটি চাকরী খুজছে তাই সে যেন টাকার ব্যাপারে কোন চিন্তা না করে । কিন্তু কথাগুলো জিসানের কানেই কেমন অসামঞ্জস্য লাগে । কারণ , সে জানে সে কত বড় বিপদে । সে মাত্র ইন্টার পাশ । এডমিশনের কোচিং করছে । তাকে কে চাকরী দিবে ? কিন্তু বাস্তবতা ইরার অজানা । সে ধনীর দুলালী । বাইরের জগৎ সম্পর্কে তার জ্ঞান শুণ্যের কোঠায় ।

 

ইরার কথায় জিসান ফিরে এল পুরনো সেই দিনগুলো থেকে ।

 

– দুপুরে আমার সাথে লাঞ্চ করবে প্লিজ ?

 

– দুঃখিত , মেসে মিল দেয়া আছে ।

 

– একটা দিন প্লিজ জিসান ?

 

– না থাক , বাদ দিন । আমার খাওয়া না খাওয়ায় কিছু যায় আসবে না ।

 

– এতটাই ঘৃণা কর আমাকে যে একবেলা লাঞ্চও করতে পারবেনা ?

 

– ছিঃ কি বলছেন ? আমার আবার ঘৃণা করা মানায়না ।

 

ইরা কাঁদছে । নিরবে কাঁদছে । হয়ত বুঝতে পেরেছে সামনে বসা এই মানুষটি রক্তে মাংসে গড়া হলেও ভিতরটা তার পাথরে পরিণত হয়েছে ।

-১৪

 

– তারপর , আপনি তো বিরাট মানুষ এখন । বিশাল এক কোম্পানীর এমডি । বাহ !

 

– আমাকে কিছুই করতে হয়নি । বাবার কোম্পানী । একটা আমি দেখছি ।

 

– কি সৌভাগ্য আমার ! মালিকের সাথে বসে গল্প করছি !

 

– টিটকারী করছ ?

 

– আরে কি যে বলেন । ধনী হওয়া বিধাতার আশীর্বাদ । আপ্নি সেই আশীর্বাদ জন্ম থেকে প্রাপ্ত ।

 

– তুমি অনেক পাল্টে গেছ । শারীরিক মানষিক দুটোই ।

 

– অভিযোজন করে নিয়েছি ।

 

অভিযোজন  কথাটা শুনে ইরার মনে পড়ল জিসান খুব খুশি খুশি গলায় বাসায় এসে বলেছিল আজ সে নিজের টাকায় বাজার করেছে । কিন্তু টাকার কথা জিজ্ঞেস করলে কোন কথাই বলছিলনা । শেষে খুব পীড়াপীড়ীর পর ইরা যা জানতে পারল তাতে সে আকাশ থেকে পড়ল । জিসান শিপইয়ার্ডে চাকরী নিয়েছে । পার্ট টাইম লেবার । জাহাজের মাল খালাশ করে !!! শুনে ইরা অনেক কেঁদেছিল । তখন জিসান ইরাকে সান্তনা দেয়ার জন্য বলেছিল , –  মাই ডিয়ার ইরাবতী , ডোন্ট ওরী , অভিযোজন করে নিচ্ছি তো । একদম সমস্যা হবেনা । ওই কান্নার মাঝেও ইরার মুখে হাসি এসেছিল । এরপর থেকে সে নিজেকে পার্ট টাইম লেবারের স্ত্রী হিসেবেই পরিচয় দিত । তার কখনই নিজেকে ছোট মনে হয়নি । কারণ , তার জিসান তার জন্য কত কষ্ট করছে , আর সে নিজেকে এতটুকু মানিয়ে নিতে পারবেনা তা কি হয় ! নিজেকে তার ছোট মনে হয়নি বরং গর্বিত মনে হত । পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী এবং ভাগ্যবতী নারী হিসেবে দাবী করতেও কুন্ঠিত হত না সে ।

 

-১৫

 

জিসান বরাবর খুব মেধাবী ছিল । সে তো এখন আর লেখাপড়া করতে পারবেনা তাই চাইছিল ইরা যেন লেখাপড়াটা চালিয়ে যায় । তাই সে নিজেই ইরাকে পড়াত । যদিও জিসান আর ইরা ক্লাশমেট তবুও জিসান এতটাই মেধাবী ছিল যে , ইরাকে সে অনায়াসেই সব বুঝিয়ে দিত ।

 

এভাবে চলে গেল প্রায় এক মাস । দিন দিন বাড়ীর প্রতি তাদের টান বাড়তে লাগল । জিসান বুঝতে পারে , সে পুরুষ , কষ্ট সহ্য করা তার জন্মগত বৈশিষ্ট্য । কিন্তু তার ইরাবতী তো জীবনে এত কষ্ট করেনি । বাবা মাকে ছেড়ে এতদিন বাইরেও থাকেনি । তার বোধয় খুব কষ্ট হচ্ছে । হয়ত তাকে বলছে না । কিন্তু তাতে কি ! সে তো তাকে হেল্প করতে পারে ।

 

– হ্যাঁ বাবা ? আমি ইরা ? কেমন আছো তুমি ?

 

ইরা ফোনে কথা বলছে । জিসান পাশে থেকে দেখছে । ইরার মুখে সুপ্ত আনন্দের ঝলক । খুশিতে উদ্ভাসিত মুখ । অনেকদিন পর পরিবারের সাথে কথা বলার খুশি । এইত চেয়েছিল জিসান তার ইরাবতী খুশি থাকুক সবসময় । কিন্তু ? ইরার মুখে কালো ছায়া নেমে আসল কেন ? ইরা জিসানের দিকে তাকাল । তার চোখ ছল ছল করছে । হাত কাঁপছে থর থর করে । জিসানের বুকটা ধ্বক করে উঠল ইরার এই অবস্থা দেখে । বুকের ভিতরটা অজানা আশংকায় কেপে উঠেছিল জিসানের ।

 

 

 

-১৬

 

৫ তলা দালানের সেই এমডি রুম । ইরা জিসান সামনাসামনি বসে আছে । এর মাঝে দুই বার তার পিএস এসে নক করেছে । কিন্তু ইরা ডিস্টার্ব করতে নিষেধ করে দিয়েছে । ইরার চোখ লাল টসটসে হয়ে আছে । সে শুধুই ভাবছে , একটা মানুষ কতটা কষ্ট পেলে এমন পাথর হয়ে যায় ! অনুভূতির ডেপো বলে খ্যাত জিসানের মাঝে আর একফোঁটা অনুভূতি অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয়না । যা আছে সব অভিমান ! কিন্তু কার উপর এই অভিমান ? তার উপর ? সে তো জিসানকে ভালোবাসে । এখনও ভালবাসে । আগের মতই ভালবাসে । সে তো সব সময় জিসানের ভালোই চেয়েছে । কিন্তু তারপরেও এত অভিমান কেন ? সেও তো অভিমান করতে পারত । এই ৫ বছরে একবারও জিসান তার খোঁজ নেয়নি । কেন ? হাজারটা প্রশ্ন আর একবুক কষ্ট নিয়ে তাকিয়ে থাকে ইরা জিসানের দিকে ।

 

কিন্তু বিধাতা হয়ত চাননি জিসানের জীবনের ট্রাজেডিগুলো ইরা জেনে থাক । কারণ বিধাতা মাঝে মাঝে দুটি জীবনকে নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন !!!

 

-১৭

 

ভালবাসা জিনিসটা মানুষের মনে থেকে যায় চিরতরে । হারিয়ে যায়না তার অস্তিত্ব । কিন্তু হারিয়ে যায় তার বহিঃপ্রকাশ । যেমনটি হয়েছে জিসানের । ইরার প্রতি তার ভালবাসা আগের মতই আছে । কিন্তু জিসান চায়না তার প্রকাশ ঘটুক । কারণ যার প্রকাশে জীবন পাল্টে যায় তার প্রকাশ না হওয়াই ভালো ।

 

চট্টগ্রাম সীপোর্ট থেকে কয়েক কিমি দূরে একটি ছোট্ট ঘর । বাবার সাথে কথা বলা শেষ করতে পারল না । কেঁদে চোখের জল নাকের জল এক করে ফেলেছে । জিসান বুঝতে পারছিলনা কি ঘটেছে । ইরাকে জিজ্ঞাসা করলে সে শুধু দুটি কথাই বলল ,  জিসান তোমার খুব বিপদ , আমাদের আজই ঢাকা যেতে হবে । প্লিজ আমাকে মাফ করে দিও ।  এর বেশী ইরা আর কিছুই বলল না । সেদিন রাতেই তারা ঢাকায় রওনা দেয় । পিছনে ফেলে তাদের শখের , স্বপ্নের , ভালোবাসা দিয়ে গড়া সংসার !

 

-১৮

 

সারারাত ইরা কাটিয়েছে কেঁদে আর জিসান কাটিয়েছে টেনশনে । ইরা তাকে কিছুই বলছিল না । বাসস্ট্যান্ডে নামতেই ঘটনা কিছুটা বুঝল জিসান । ঘটনাগুলো যেন কোন পরাবাস্তব দুনিয়ায় ঘটে যাচ্ছে যেখানে তার কিছুই করার নাই শুধু দেখা ছাড়া ।

 

পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গেল । ৩ টা কেসঃ নারী নির্যাতন , অপহরণ , বাল্যবিবাহ । প্রধান আসামী জিসান , দ্বিতীয় আসামী তার বাবা মা , ৩য় তার আত্নীয়রা ! প্রত্যেকেই নজরবন্দী । জিসান দেখতে পারে টাকার ক্ষমতা যে ক্ষমতার কাছে সব তুচ্ছ ! কিন্তু তার আরো অনেক কিছুই দেখার বাকী ছিল তখনও ।

 

আপাতত তাদের একটা জবানবন্দী নেয় পুলিশ । তাতে দুইজনের কথা মিলে যায় । ইরা জিসান দুইজনের মনেই আশার আলো জ্বলে ওঠে এই ভেবে যে তাদের আর কেউ আলাদা করতে পারবে না । আহা তারা যদি বাস্তবতার কালো পর্দার আড়ালের জগত্টা চিনত । দুপুরের আগেই ইরার বাবা ইরাকে নিয়ে যায় । কিন্তু আইনের প্যাঁচে জিসান থেকে যায় জেলেই । পুলিশ বলে দেয় কাল তাকে কোর্টে চালান করে দেয়া হবে যেখান থেকে শুরু হবে জিসানের আরেকটি জীবন ।

 

-১৯

 

ইরা দাড়িয়ে আছে জিসানের মুখোমুখি । ঠিক সামনের এজলাশে । এখন ইরার সাক্ষী । ইরা নির্বিকার মুখে বলা যা বলল , তাতে জিসান যতটা অবাক হল , তার জীবনে সে অতটা অবাক হয়নি । সে সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল । এটা কি ঠিক শুনল জিসান ? ইরাকে সে জোড় করে উঠিয়ে নিয়ে গেছে ! তাকে জোড় করে বিয়ে করেছে ! এই ভালোবাসে ইরাবতী তাকে ! জিসানের সামনের সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল । সে আর কিছুই বলল না । মনে মনে ঠিক করে নিল জিসান , এতে যদি তার ইরাবতী সুখে থাকে তবে তাই হোক ! বরং তারই বা কি যোগ্যতা আছে এত বড়লোকের মেয়ের সাথে সংসার করার ! মাথা নিচু করে ফেলল সে । আর তাকাতে চায়না সে ইরার দিকে । পায়ের কাছে পড়ে থাকা ধুলোবালি গুলো কোন এক মানুষের অশ্রুজলে সিক্ত হতে থাকে । সেই অশ্রুজলধারাও যেন সেখানে ইরাবতীর ছবি একে দিচ্ছে !

 

-২০

 

আজ জিসানের রায় হবে । আজ ইরাও চলে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া । তার কিছুই করার নাই । সে নিরুপায় । তার কানে এখন বাজছে বাবার সেই কথাগুলো ,  তুমি সত্য বললেও কিছু হবে না , মিথ্যা বললেও কিছু হবে না । কারণ আমার ক্ষমতার দৌড় অনেক । তবে তুমি যদি মিথ্যা বল তাহলে হয়ত ওই শুয়োরের বাপ মা বেঁচে যাবে ! তবে তুমি যদি বিদেশ চলে যাও তবে আমি জিসানকে বাঁচাতে পারি !  ইরার পুরো শরীর হীম হয়ে আসছে ! সে এটা কি করল ! কিভাবে করতে পারল এটা ! হোক , তবুও যদি , জিসানের বাবা মা ভালো থাকে তবে সে সার্থক । জিসান হয়ত কোনদিন তাকে মাফ করবে না । কিন্তু সে তো তার ভালোর জন্যই এতগুলো মিথ্যা বলল , এতগুলো ত্যাগকে স্বীকার করল ! এটাই তো ভালোবাসা , প্রকৃত ভালোবাসা ! সে জিসানকে সত্যি ভালোবাসে , অনেক ভালবাসে !

 

কাঁদছেন কেন আপনি ?  – জিসানের কথায় ইরা ফিরে এল সেই বিভীষীকাময় দিনগুলো থেকে বর্তমানে । জিসানের চোখের দিকে তাকাল । আস্তে আস্তে , খুব নিচু গলায় বলল ,

 

– আমাকে মাফ করে দিতে পারো না ?

 

– ছিঃ এসব কি বলছেন ? আমি মাফ করার কে ? আর আপনি যা করেছেন তা ভালোর জন্যই করেছেন ! তা না করলে আজ তো আপনি আর এই চেয়ারে বসতে পারতেন না ! আপনাকে থাকতে হত এক গরীব লেবারের বৌ হিসেবে !

 

– আমি কিন্তু এখনও তোমার স্ত্রী !

 

– হা হা হা ! এই কথাটা ৫ বছর পর মনে পড়ল হঠাৎ ???

 

– প্লিজ আমায় ভুল বুঝো না । আমি অস্ট্রেলিয়া ছিলাম । ফিরে এসে তোমাদের বাসায় গেছিলাম কিন্তু তোমরা ওখানে ছিলে না !

 

– থাকতে পারিনি ম্যাডাম ! আপনি কি জানেন আমার তিন বছর জেলের রায় হয়েছিল ! আমার পরিবার তার সর্বস্ব দিয়ে আমায় ছাড়িয়ে এনেছে । যদিও আমাকে ১১ মাস জেলে থাকতে হয়েছে ! এরপর আমরা চলে আসি দেশের বাড়ীতে ।

 

ইরার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল সে যেকোন মুহূর্তে চিৎকার করে কেঁদে উঠবে !

 

ভারী গলায় বলল ,

 

– মা বাবা ভালো আছেন ?

 

– মা বেঁচে আছেন , বাবা নেই । আমি জেল থেকে বেড় হবার পরের বছর মারা গেছেন ।

 

(২১)

 

৫ তলা দালান । এমডির রুম । এক যুবক মাথা নিচু করে বসে আছে । এক যুবতী যুবকের পায়ের কাছে হাউমাউ করে কাঁদছে । চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে সেই যুবককে বলছে ,  আমাকে প্লিজ মাফ করে দাও । আমি নিরুপায় ছিলাম । আমি যদি তা না করতাম তবে মা বাবা কেও জেলে যেতে হত ! প্লিজ আমার সাথে এত রুড হইয়ো না । চল প্লিজ আমরা নতুন করে সবকিছু শুরু করি ।

 

– যে তীর ছোঁড়া হয় তা যেমন ফিরে আসেনা যে অতীত যায় সেটাও আর নতুন হয় না । আমি মাটির মানুষ , আমার চাঁদে হাত দেয়া অপরাধ ম্যাডাম !

 

ইরাবতী জিসানের পা জড়িয়ে ইরাবতী নদীর ন্যায় চোখের জল ফেলছে ! জিসানের চোখ ভিজে গেল । বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠল । বুঝতে পারল , এখানে থাকা তার উচিৎ হবেনা ! টলমল পায়ে উঠে দাড়াল জিসান । হাটা ধরল দরজার দিকে । মেঝেতে পড়ে ডুকড়ে ডুকড়ে কাঁদছে তার ইরাবতী । জিসান নিজেকে আটকাতে পারেনা । চোখের পানিতে ভিজিয়ে ফেলে শার্ট ! দরজা খুলে বেড় হয়ে আসে সে । পিছনে ফেলে আসে তার জীবনের চাইতেও বেশীকিছু । সিলিংয়ের দিকে মুখ করে বলে ,  বিধাতা , তুমি যদি সত্যি থেকে থাকো , তবে পৃথিবীর সকল প্রেমিকের অদ্বিতীয়াকে সুখে রেখ !

 

জিসান হাটছে । পিছনে তাকাচ্ছেনা সে পাছে পিছুটান চলে আসে !